▌আমাদের আকিদা ও দাওয়াত
- AL-INABAH ACADEMY
- Feb 2, 2022
- 15 min read
লেখক: ইমাম মুকবিল বিন হাদি আল-ওয়াদিয়ি রাহিমাহুল্লাহ
অনুবাদকের কথা: মানুষ অন্তরে যে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সেটাই তার আকিদা, অন্তরের বিশ্বাস। মানুষের আকিদা যেন সংশোধিত ও প্রমাদমুক্ত হয়, সেজন্য যুগে যুগে অসংখ্য রসুল প্রেরিত হয়েছেন। আমাদের প্রিয় নবিজি ﷺ মক্কায় প্রায় তেরো বছর স্রেফ আকিদা সংশোধনের দাওয়াত দিয়েছেন। আকিদার দাওয়াত দিয়েই শুরু করতে বলেছেন দাওয়াতি কার্যক্রম। কারণ আকিদা বিশুদ্ধতার মাঝেই রয়েছে মানবতার মুক্তি। এসব বিষয় কুরআন-সুন্নাহয় বহুবার বহুভাবে বিবৃত হয়েছে। এজন্য আমাদের পূর্বসূরি ইমামগণের যুগ থেকে চলে আসছে সংক্ষিপ্ত কলেবরে আকিদা লিখনের ধারা। শাইখুল ইসলামের সুপ্রসিদ্ধ ওয়াসিতিয়্যাহ আর ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের সালাসাতুল উসুলের মতো মৌলিক বই লেখার ধারা আধুনিক যুগেও চলমান রয়েছে। এই ধাঁচেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বুকলেট— ইয়েমেনের সালাফি দাওয়াহর মুজাদ্দিদ ইমাম মুকবিল বিন হাদি আল-ওয়াদিয়ি রাহিমাহুল্লাহ বিরচিত ‘আমাদের আকিদা ও দাওয়াত।’ আকিদার নানাবিধ প্রয়োজনীয় বুকলেটের ভিড়েও বর্তমান সময়ে এ বুকলেটটির গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ ইমাম মুকবিল রাহিমাহুল্লাহ এতে এমনকিছু আকিদা ও সালাফি দাওয়াতের কর্মপন্থা নিয়ে কথা বলেছেন, যা বর্তমান সময়ের সাথেই মানানসই। এসব কথা পূর্ববর্তী আকিদার বুকলেটগুলোতে নেই। যেমন সাম্যবাদ (communism), ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (secularism), জামায়াতে ইসলামীর আরব সংস্করণ মুসলিম ব্রাদারহুড, তাবলিগ জামাত প্রভৃতি বিষয়ে একজন মুসলিমের অবস্থান কেমন হবে তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেছেন ইমাম মুকবিল। পুস্তিকাটির অনুবাদ আল্লাহর কাছে গৃহীত হোক এবং আমাদের শ্রম স্রেফ আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হোক সে দোয়া করি। আরও দোয়া করি, এ পুস্তিকার দাওয়াত পৌঁছে যাক প্রতিটি গৃহে, পরিশুদ্ধ হোক মানুষের আকিদা। আমিন, ইয়া রব্বাল আলামিন। · বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। · [অবতরণিকা] নিশ্চয় সমুদয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদিত। আমরা তাঁর সাহায্য চাইছি এবং তাঁর কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাদের আত্মার অনিষ্ট ও মন্দ আমল থেকেও আল্লাহর শরণ যাচ্ঞা করছি। আল্লাহ যাকে সুপথ দেখান, তাকে কেউ বিপথগামী করতে পারে না। আর যাকে বিপথগামী করেন, তাকে কেউ সুপথে আনতে পারে না। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রসুল। হে ইমানদারগণ, আল্লাহকে যথাযথ ভয় করতে থাক এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ কোরো না। [সুরা আলে ইমরান: ১০২] হে মানবমণ্ডলী, তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একটি প্রাণ (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচ্ঞা করে থাক এবং আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর (তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে সাবধান থাক)। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন। [সুরা নিসা: ১] হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং নায্য কথা বল। তিনি তোমাদের কর্মাবলি সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন। যে ব্যক্তিই আল্লাহ ও তার রসুলের আনুগত্য করবে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে। [সুরা আহজাব: ৭০-৭১] অনন্তর যখন নানাবিধ আকিদার সংখ্যা বেড়েই চলেছে, হরেকরকম দাওয়াত প্রসার লাভ করছে, আর সেসব আকিদা ও দাওয়াতের ধারক-বাহকদের অবস্থা হয়েছে এমন, যেমনটি মহান আল্লাহ বলেছেন, فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا ۖ كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ “মানুষ নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে বহুধা বিভক্ত করেছে; প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়েই উৎফুল্ল।” [সুরা মুমিনুন: ৫৫] এদের অবস্থা হয়েছে এই প্রবচনটির মতো, “কুল্লুই ইয়াদ্দাঈ ওয়াসলান লি লাইলা ~ ওয়া লাইলা লা তুক্বির্রু লাহুম বি যাক; লায়লার সাথে মিলনের দাবি করে যায় সবাই, কিন্তু লায়লামণি তাদের কথায় দেয় না যে সায়!” এমন কোনো দাওয়াতের ধারকবাহক পাবেন না, যারা কিনা নিজেদেরকে ‘সঠিকপথের পথিক’ দাবি করে না। এই তো ফেরাউন, যে কিনা বলেছিল, فَقَالَ أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَىٰ “সে বলল, আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ প্রভু।” [সুরা নাযি‘আত: ২৪] সে তার সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেছিল, مَا أُرِيكُمْ إِلَّا مَا أَرَىٰ وَمَا أَهْدِيكُمْ إِلَّا سَبِيلَ الرَّشَادِ “আমি যা বুঝি, আমি তোমাদের তাই বলছি। আমি তোমাদেরকে কেবল সুপথই দেখিয়ে থাকি।” [সুরা গাফির: ২৯] সে আল্লাহর নবি মুসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে বলেছিল, ذَرُونِي أَقْتُلْ مُوسَىٰ وَلْيَدْعُ رَبَّهُ ۖ إِنِّي أَخَافُ أَنْ يُبَدِّلَ دِينَكُمْ أَوْ أَنْ يُظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ “আমাকে ছাড় তোমরা, আমি মুসাকে হত্যা করি এবং সে তার রবকে ডাকতে থাকুক। আমি আশঙ্কা করছি, সে তোমাদের ধর্মের পরিবর্তন ঘটাবে কিংবা পৃথিবীতে সৃষ্টি করবে বিপর্যয়।” [সুরা গাফির: ২৬] ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় মুসা ও হারুন আলাইহিমাস সালামের ব্যাপারে বলেছিল, إِنْ هَٰذَانِ لَسَاحِرَانِ يُرِيدَانِ أَنْ يُخْرِجَاكُمْ مِنْ أَرْضِكُمْ بِسِحْرِهِمَا وَيَذْهَبَا بِطَرِيقَتِكُمُ الْمُثْلَىٰ “এই দুজন অবশ্যই জাদুকর, তারা চায় তাদের জাদুর সাহায্যে তোমাদেরকে তোমাদের দেশ হতে বিতাড়িত করতে এবং তোমাদের প্রকৃষ্ট জীবনব্যবস্থার বিনাশ সাধন করতে।” [সুরা তহা: ৬৯] মুনাফেকদের দাবি-দাওয়া প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন, وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ “যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কোরো না, তখন তারা বলে, আমরা তো শুধুই শান্তি স্থাপনকারী।” [সুরা বাকারা: ১১] মহান আল্লাহ আরও বলেছেন, أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَٰكِنْ لَا يَشْعُرُونَ * وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ ۗ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَٰكِنْ لَا يَعْلَمُونَ “জেনে রেখ, নিশ্চয় তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা উপলব্ধি করতে পারে না। এবং যখন তাদের বলা হয়, ‘লোকেরা যেরূপ ইমান এনেছে, তোমরাও তদ্রুপ ইমান আন,’ তখন তারা বলে, ‘নির্বোধেরা যেরূপ ইমান এনেছে, আমরাও কি সেরূপ ইমান আনব?’ জেনে রেখ, নিশ্চয় এরাই নির্বোধ, কিন্তু তারা তা অবগত নয়।” [সুরা বাকারা: ১২-১৩] আপনাকে একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। ইসমায়িলিয়্যা শিয়া ফের্কা একটি ধর্মচ্যুত বিপথগামী দল। নাজরান, ফুরু (Al-Fera), আতফাইন, ইহসা, কাতিফ, বাহরাইন ও মদিনায় এরা ‘নাখাবিলা’ নামে পরিচিত। আর হারায, আরাস, নুকুম, সানা ও ভারতে এরা এবং এদের শাইখরা ‘মাকারিমা (মর্যাদাভাজন)’ নামে পরিচিত, যদিও তারা বাস্তবে মর্যাদাভাজন নয়। মাকারিমা সম্প্রদায় আল্লাহ, তদীয় রসুল ও ইসলামের বিরোধিতাকারী ধর্মচ্যুত বাতিনি মতাদর্শের দিকে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। এদের পূর্বসূরিরা আল্লাহর সম্মাননীয় গৃহ বাইতুল হারামে হাজিদের হত্যা করেছিল এবং হাজারে আসওয়াদ (কালো পাথর) তুলে নিয়ে গিয়েছিল। হাজারে আসওয়াদ তাদের কাছে কিছুদিন ছিল, এরপর তারা কেবল পাথরের একটি খণ্ড ফেরত দিয়েছিল। মাকারিমা সম্প্রদায় মুসলিম নয়। বরং তারা ইহুদি-খ্রিষ্টানের চেয়েও ইসলামের জন্য বেশি ক্ষতিকর। এ সত্ত্বেও তারা বইপুস্তক এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রচারণার (financial promoting) মাধ্যমে তাদের দাওয়াত প্রচার করে চলেছে। এমনকি নাজরানের একদল লোক ইয়েমেনের কিছু দুর্বলচিত্ত মানুষের আনুগত্য স্বীকার করেছে। তারা মনে করে, ওই লোকেরা তাদেরকে সৌদি আরবের সাথে সংযুক্ত হওয়ার দাওয়াত দেয়। বাস্তবে তারা সৌদি আরবের সাথে যুক্ত হওয়ার দাওয়াত দেয় না, বরং বাতিনি কারমাতি ইসমায়িলি মতাদর্শের সাথে মিলিত হওয়ার দাওয়াত দেয়। তারা সৌদি আরবকে ভালোবাসে না এবং তাদের বাতিল মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমন কাউকে ভালোবাসে না। আমি তাদের ব্যাপারে জেনে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ কথা বলছি। কারণ আমি বছর দুয়েকের মতো নাজরানে ছিলাম। একরাতে আমি জনৈক নাজরানবাসীর কাছে গমন করলাম। সেখানে আমি এদের একটি বই পেয়ে পড়তে শুরু করি। হঠাৎ দেখি, বইয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভ্রান্ত লিখে রাখা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَذْبَحُوا بَقَرَةً “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন, তোমরা একটি গরু জবেহ করো।” [সুরা বাকারা: ৬৭] তারা ব্যক্ত করেছে, ‘এর মানে আয়িশাকে জবাই করো।’ অথচ কুরআনের মুসলিম পাঠকমাত্রই জানেন, এ কথা মুসা ও তার সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বলা হয়েছে। এরপর ‘জিবত ও তাগুত’ মানে আবু বকর ও ওমর! অথচ নবুওতের যুগে ও তৎপরবর্তী সময়ে ইসলামের জন্য তাঁদের দুজনের বরকতময় অবস্থানের কথা সকল মুসলিমের কাছে সুবিদিত। তাঁরা দুজনেই জান্নাতবাসী, যেমনটি বর্ণিত হয়েছে অসংখ্য হাদিসে। তারা তাদের অনুসারীদের বোঝায়, তারা আহলুল বাইতকে ভালোবাসে। নবি-পরিবারের প্রতি—আল্লাহ তাঁদেরকে রহম করুন—ভালোবাসার দাবিতে ইসলামের ওপর কত দুর্যোগই না এসেছে! এসব অসত্য ও বাতিল কথা, আর মিথ্যা দাবির কারণে এবং নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে অনেক মুসলিমের অজ্ঞতা থাকার কারণে অসংখ্য মুসলিম দিশেহারা হয়ে গেছে। যেমন অনেক মুসলিম আমাকে এ ব্যাপারটি অবহিত করেছে। এতদ্ব্যতীত কমিউনিস্ট, বাথিস্ট, রাফেজি শিয়া ও সুফি সম্প্রদায়ের অভিশপ্ত দাবিদাওয়া রয়েছে, যারা কিনা মুসলিম জনসাধারণকে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী দায়িদের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। তাই আমি ইয়েমেনে আহলুস সুন্নাহর দাওয়াহ বিষয়ে কিছু সারকথা সংকলন করার ইচ্ছে করলাম। আল্লাহর কাছে তৌফিক চেয়েই আমি ব্যক্ত করছি। · ❏ আমাদের আকিদা ও দাওয়াত: [১]. আমরা আল্লাহর প্রতি ইমান রাখি এবং তাঁর নাম ও গুণাবলির প্রতি সেভাবে ইমান রাখি, যেভাবে আল্লাহর কিতাব এবং রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলা-আলিহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহয় বর্ণিত হয়েছে; ইমান রাখি কোনোরূপ বিকৃতি, অপব্যাখ্যা, পূর্ণাঙ্গ সাদৃশ্যদান, আংশিক সাদৃশ্যদান ও নিস্ক্রীয়করণ (অস্বীকার, বা অপব্যাখ্যা, বা অর্থ-অস্বীকৃতি) ব্যতিরেকে। [২]. আমরা আকিদা (বিশ্বাস) রাখি, মৃতদের ডাকা এবং তাদের কাছে ফরিয়াদ করা, তদ্রুপ আল্লাহ ছাড়া কেউ সক্ষম নয় এমন কার্যে জীবিতদের ডাকা এবং তাদের কাছে ফরিয়াদ করা আল্লাহর সাথে অংশীস্থাপন (শিরক)। অনুরূপভাবে তাবিজ-কবচে বিশ্বাস করা যে, এগুলো আল্লাহর সাথে সাথে কিংবা আল্লাহকে ব্যতিরেকেই উপকার করতে পারে, তাহলে এমন আকিদা রাখা শির্ক। আর কোনো আকিদা না রেখে এগুলো লটকানো বা বহন করা কুসংস্কার। [৩]. আমরা কুরআন ও সুন্নাহর প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করি এবং ভিন্ন অর্থে ব্যাখ্যা করার মতো উপযোগী কুরআন-সুন্নাহর দলিল ব্যতিরেকে প্রকাশ্য অর্থের ভিন্ন ব্যাখ্যা (তাবিল) করি না। · [৪]. আমরা ইমান রাখি, মুমিনরা পরকালে তাদের রবকে দেখতে পাবে; তবে এর ধরন আমাদের অজানা। এছাড়াও আমরা শাফায়াতের প্রতি বিশ্বাস রাখি এবং তাওহিদবাদিরা যে জাহান্নাম থেকে বের হবে তাও বিশ্বাস করি। [৫]. আমরা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলা-আলিহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিবর্গকে ভালোবাসি এবং যারা তাঁদের সমালোচনা করে তাদেরকে ঘৃণা করি। আমরা আকিদা রাখি, সাহাবিদের নিন্দা-সমালোচনা করা দ্বীনের নিন্দা করার নামান্তর। কেননা তাঁরাই এ দ্বীন আমাদের কাছে পৌঁছিয়েছেন। আর শরিয়তে যেভাবে অনুমোদিত নবি-পরিবারকে আমরা সেভাবেই ভালোবাসি। [৬]. আমরা আহলুস সুন্নাহর সমগ্র সালাফকে (ন্যায়পন্থি পূর্বসূরিকে) এবং আহলুল হাদিসকে ভালোবাসি। [৭]. আমরা ইলমুল কালামকে (গ্রিক-ফিলোসফির কথিত ইসলামিক ভার্শন) ঘৃণা করি এবং মনে করি, এটাই উম্মাহ বিভক্তির অন্যতম প্রধান উপকরণ। · [৮]. আল্লাহ ও তাঁর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলা-আলিহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা প্রমাণিত হয়েছে তা ব্যতিরেকে আমরা ফিকহ ও তাফসিরের বইপুস্তক এবং প্রাচীন কেচ্ছা-কাহিনী ও নবিচরিতের কিছুই গ্রহণ করি না। এর মানে এই নয় যে, আমরা এসব বইপুস্তক ছুঁড়ে ফেলব; কিংবা এমন ধারণা রাখব যে, আমরা এসব বইপুস্তক থেকে মুক্ত। বরং আমরা আমাদের উলামা, ফাকিহবর্গ ও অন্যান্যদের গবেষণা থেকে উপকৃত হব। কিন্তু বিশুদ্ধ দলিল ব্যতিরেকে কোনো বিধান গ্রহণ করব না। [৯]. আমরা কুরআন কিংবা দলিলগ্রহণের উপযুক্ত হাদিস ব্যতিরেকে আমাদের লিখনগুলোতে কিছু লিপিবদ্ধ করি না, আমাদের দারসগুলোতে বক্তব্য রাখি না এবং খুতবা দিই না। আর অসংখ্য লেখক ও বক্তাদের থেকে প্রকাশিত মিথ্যা কেচ্ছা এবং দুর্বল ও জাল হাদিসগুলো আমরা অপছন্দ করি। [১০]. আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করা, কিংবা নামাজ পরিত্যাগ করা, অথবা ধর্মত্যাগ করার মতো অপরাধ ব্যতীত (অর্থাৎ বড়ো কুফর ব্যতীত) অন্য কোনো গুনাহর কারণে কোনো মুসলিমকে আমরা কাফির বলি না। আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের এ থেকে রক্ষা করুন। · [১১]. আমরা ইমান রাখি, কুরআন আল্লাহর কথা, এটা সৃষ্ট নয়। [১২]. আমরা হকের ক্ষেত্রে যে কোনো মুসলিমের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা বিনিময় করা ওয়াজিব মনে করি এবং যাবতীয় জাহেলি দাওয়াত (অর্থাৎ দলবাজি দাওয়াত) থেকে আল্লাহর কাছে নিজেদের মুক্ত ঘোষণা করি। [১৩]. আমরা মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৈধ মনে করি না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মুসলিম থাকে। আর বিপ্লব-আন্দোলনকে আমরা সংশোধনের উপায় মনে করি না, বরং সমাজ ধ্বংসের মাধ্যম মনে করি। পক্ষান্তরে আদনের শাসকদের সাথে যুদ্ধ করা আমরা ওয়াজিব মনে করি; যে পর্যন্ত না তারা তওবা করছে নাস্তিকতা ও সমাজতন্ত্র থেকে এবং মানুষদেরকে লেনিন-মার্ক্স ও অন্যান্য কাফির নেতাদের পূজো করার প্রতি ডাকাডাকি থেকে। [ইমাম মুকবিল রাহিমাহুল্লাহ পাদটীকায় লিখেছেন, “আল্লাহ তাদেরকে পরাভূতকারী পরাক্রমশালীর ন্যায় পাকড়াও করেছেন। এখন এ রাষ্ট্রের শাসকরা মুসলিম।” টীকা সমাপ্ত] · [১৪]. আমরা এই ক্রমবর্ধমান সামসময়িক দলগুলোকে মুসলিমদের বিভক্তি ও দৌর্বল্যের কারণ মনে করি। [১৫]. আমরা সমাজ সংশোধনের ক্ষেত্রে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের (Muslim Brotherhood) দাওয়াতকে অনুপযোগী ও অক্ষম মনে করি। কারণ এ দাওয়াত রাজনৈতিক দাওয়াতে পরিণত হয়েছে। এটা রুহানি (হার্দিক ও ইমানি) দাওয়াত নয়। উপরন্তু এটা বিদাতি দাওয়াতে পরিণত হয়েছে। কেননা এদের দাওয়াত অজ্ঞাতপরিচয় লোকের কাছে বায়াত নিতে আহ্বান জানায়। আর এটা ফিতনার দাওয়াতেও পরিণত হয়েছে। কেননা এ দাওয়াত অজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং অজ্ঞতার ওপরই চলমান। আমাদের কিছু সম্মাননীয় ভাই এ সংগঠনে কর্মরত রয়েছেন। আমরা তাঁদেরকে এই সংগঠন ত্যাগ করতে নসিহত করছি। যাতে ইসলাম ও মুসলিমদের কল্যাণে তাঁদের ব্যয়িত সময়গুলো বিনষ্ট না হয়। আর একজন মুসলিমের লক্ষ্য হওয়া উচিত—আল্লাহ যেন ইসলাম ও মুসলিমদের সাহায্য করেন। · [১৬]. আর তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে আমি সম্মাননীয় ভাই মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব আল-ওয়াসাবি হাফিযাহুল্লাহ লিখিত কথা পেশ করছি। [ইনি ছিলেন ইয়েমেনের একজন প্রথিতযশা আলিম এবং ইমাম মুকবিলের অত্যন্ত নিকটের সেরা ছাত্র। তিনি ২০১৫ সালে মারা গিয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে রহম করুন। – অনুবাদক] তিনি (শাইখ ওয়াসাবি) বলেছেন— ক. তাবলিগ জামাতের লোকেরা দুর্বল হাদিস আমল করে, বরং বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হাদিসও আমল করে। খ. এদের মধ্যে অনেক বিদাত পাওয়া যায়। বরং এদের দাওয়াত বিদাতের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এদের দাওয়াতের মেরুদণ্ডই হলো সময় নির্দিষ্ট করে দাওয়াতে বের হওয়া—প্রত্যেক মাসে তিনদিন, বছরে চল্লিশ দিন, জীবনে চার মাস, ফি-হপ্তায় দুবার ভ্রমণ, একবার যে মসজিদে নামাজ পড়ে সেখানে, আরেকবার পরিবর্তনশীল অস্থায়ী কোনো স্থানে। আর প্রতিদিন দুটো হালাকা হবে। যে মসজিদে নামাজ পড়ে সেখানে একটা হবে, আরেকটা হবে বাড়িতে। তাদের আদর্শ গ্রহণ না করা পর্যন্ত কখনোই তারা একজন ব্যক্তির প্রতি সন্তুষ্ট হবে না। নিঃসন্দেহে তাদের এ কর্ম দ্বীনের মধ্যে নবআবিষ্কৃত বিদাত, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো দলিল অবতীর্ণ করেননি। গ. এরা মনে করে, তাওহিদের দিকে দাওয়াত দিলে উম্মতকে খেদানো হয়। ঘ. এরা মনে করে, সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিলে উম্মতকে খেদানো হয়। ঙ. হাদিদা এলাকায় নিযুক্ত তাবলিগ জামাতের আমির বলেছে, যে বিদাত জনমানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, তা ওই সুন্নাতের চেয়ে উত্তম, যা মানুষদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে! চ. এরা পরোক্ষভাবে আহলুস সুন্নাহর প্রতি বিদ্বেষ জাহির করে। ছ. ইঙ্গিতে ও প্রকাশ্যে এরা ফলপ্রসূ ইলমের ব্যাপারে মানুষদের নিরুৎসাহিত করে। জ. এরা মনে করে, তাদের পথ না ধরলে মানুষের মুক্তি নেই। এ মর্মে তারা দৃষ্টান্ত পেশ করে নুহ আলাইহিস সালামের কিশতি দিয়ে। যে উক্ত কিশতিতে আরোহণ করেছে, সে পরিত্রাণ লাভ করেছে, আর যে তাতে আরোহণ করেনি, সে-ই ধ্বংস হয়েছে। তারা বলে, ‘আমাদের দাওয়াত ঠিক নুহ আলাইহিস সালামের কিশতির মতো।’ আমি জর্ডান ও ইয়েমেনে তাদের কাছ থেকে এ দৃষ্টান্তের বিবরণ শুনেছি। ঝ. এরা তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ এবং তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাতের প্রতি গুরুত্ব দেয় না। [অনুবাদকের টীকা: আল্লাহ বান্দার জন্য যেসব কাজ ইবাদত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, বান্দাদের সেসব কাজে আল্লাহকে এক গণ্য করাকে ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ’ বলে। সোজা কথায়, যাবতীয় ইবদাত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করাকে ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ’ বলা হয়। আর যেসব নাম ও গুণাবলি আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, সেসবের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহকে এক হিসেবে মেনে নেওয়াকে বলা হয় ‘তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত।’ শেষোক্ত তাওহিদের দাবি হলো: কোনোরূপ অর্থ বা শব্দগত বিকৃতি, অস্বীকার, অপব্যাখ্যা, বা অর্থ-অস্বীকৃতি না করে এবং ধরন ও সাদৃশ্য বর্ণনা না করে—আল্লাহর জন্য তিনি নিজে যেসব নাম ও গুণ সাব্যস্ত করেছেন এবং তাঁর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা সাব্যস্ত করেছেন তা সাব্যস্ত করা; আর আল্লাহর তরফ থেকে তিনি নিজে যে গুণ নাকচ করেছেন এবং তাঁর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নাকচ করেছেন তা নাকচ করা। টীকা সমাপ্ত] ঞ. তারা ইলম অর্জনের জন্য প্রস্তুত নয়। বরং এরা ইলম অর্জনের নিমিত্তে ব্যয়িত সময়কে পণ্ড মনে করে। উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও তাদের মধ্যে আরও বিচ্যুতি রয়েছে। শাইখ ওয়াসাবির বক্তব্য সমাপ্ত। · [১৭]. আল্লাহর কিতাব ও রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ বোঝার ক্ষেত্রে আমরা উম্মতের মুহাদ্দিস সালাফগণের (পূর্বসূরিদের) সমঝ মেনে চলি, তাঁদের কোনো একক ব্যক্তির অন্ধ অনুকরণ করি না। বরং যে ব্যক্তিই হক নিয়ে আসেন, আমরা তার কাছ থেকে হকটা গ্রহণ করি। আমরা জানি, কেউ কেউ এমন আছে, যারা সালাফিয়াতের দাবি করে বটে, কিন্তু সালাফি মতাদর্শ তাদের থেকে মুক্ত। কেননা এরা আল্লাহর হারামকৃত বিষয়কে হালাল করার ক্ষেত্রে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। যেমন আব্দুর রহমান আব্দুল খালিক ও মুহাম্মাদ সুরুরের সাঙ্গপাঙ্গরা। [১৮]. আমরা আকিদা রাখি, রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতি দ্বীনের অংশ। যারা দ্বীনকে রাষ্ট্রনীতি থেকে আলাদা করার চেষ্টা চালায়, এরা মূলত দ্বীনকে ধ্বংস করার এবং গোলযোগ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তদ্রুপ কতিপয় ইসলামি রাষ্ট্রে যে কথা ছড়িয়েছে, অর্থাৎ ‘ধর্ম আল্লাহর, আর রাষ্ট্র সবার’—এ কথা হলো জাহেলি দাওয়াত (এ মতবাদ ইসলাম থেকে খারিজকারী বড়ো কুফর)। বরং সবকিছুই আল্লাহর (ধর্মও আল্লাহর, রাষ্ট্রও আল্লাহর)। [অনুবাদকের টীকা: এখানে ইমাম মুকবিল রাহিমাহুল্লাহ সেকুলারিজম তথা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের তত্ত্বকথা ব্যক্ত করেছেন। রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত করাই এ মতবাদের সারকথা। অর্থাৎ হত্যা, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচারের অপবাদ প্রভৃতি দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে শরিয়ার আইন চলবে না এটাই এ মতবাদের আকিদা। এ আকিদা সরাসরি বড়ো কুফর, যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এ আকিদা গণতন্ত্রের আকিদাতেও বিদ্যমান। গণতন্ত্রের আকিদা হলো—রাষ্ট্র পরিচালিত হবে জনগণের মস্তিষ্কপ্রসূত আইন দিয়ে, শরিয়ার আইন দিয়ে নয়। উক্ত আকিদাও বড়ো কুফর, যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। ইমাম মুকবিল আল-ওয়াদিয়ি রাহিমাহুল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, “গণতন্ত্র কুফর। কেননা মহান আল্লাহ তাঁর মহিমান্বিত কিতাবে বলেছেন, ‘বিধান দেওয়ার কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহরই।’ (সুরা আনআম: ৫৭; সুরা ইউসুফ: ৪০ ও ৬৭) তিনি আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, সে অনুযায়ী যারা বিচার-ফায়সালা করে না তারাই কাফির।’ (সুরা মায়িদা: ৪৪) তিনি আরও বলেছেন, ‘তারা কি তবে জাহিলিয়্যাতের বিধান চায়? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম?’ (সুরা মায়িদা: ৫০) আমাদের গণতন্ত্রের প্রয়োজন নেই। বরং দ্বীনে ইসলাম মুসলিমদের মধ্যে শান্তিস্থাপন করেছে এবং তাদেরকে ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ করেছে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর অত্যাচার করবে না, তাকে অপদস্ত করবে না এবং হেয় প্রতিপন্ন করবে না। ‘তাকওয়া এখানে’, এ কথা বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার তাঁর বুকের দিকে ইঙ্গিত করলেন। একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে হেয় জ্ঞান করে। একজন মুসলিমের উপর প্রত্যেক মুসলিমের জান, মাল ও ইজ্জত (সম্মান) হারাম।’ (সহিহ মুসলিম, হা: ২৫৬৪; সদ্ব্যবহার অধ্যায়; পরিচ্ছেদ: ১০) আমরা গণতন্ত্রের মুখাপেক্ষী নই। কেননা এর অর্থ—জনগণ কর্তৃক নিজেই নিজের বিচার-ফায়সালা করা। অর্থাৎ, কুরআনও নেই, সুন্নাহও নেই। অথচ মহান আল্লাহ কুরআন ও সুন্নাহ ত্রুটিমুক্ত হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যেমনটি সহিহ মুসলিমে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি তোমাদের মাঝে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি– যা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব।’ (সহিহ মুসলিম, হা: ১২১৮; হজ অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ১৯) আর মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় এই কুরআন এমন একটি পথ দেখায়, যা সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত ও সঠিক।’ (সুরা ইসরা: ৯) গণতন্ত্র হলো হারামকে হালাল করার ব্যাপারে ভোটদান করার প্রক্রিয়া। কিছু কাফির রাষ্ট্রে তারা (গণতন্ত্রপন্থিরা) এই মর্মে ভোটাভুটি করেছে যে, একজন পুরুষের জন্য আরেকজন পুরুষকে বিয়ে করা বৈধ! গণতন্ত্র কুৎসিত ও বিকৃত। গণতন্ত্র সৎ ও পাপাচারীকে সমান গণ্য করে। অথচ মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুমিন, সে কি ফাসেক ব্যক্তির (অবিশ্বাসী এবং পাপীর) মতো? এরা সমান নয়।’ (সুরা সাজদাহ: ১৮) গণতন্ত্র নারী ও পুরুষকে সমান গণ্য করে। অথচ মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর পুরুষ নারীর মত নয়।’ (সুরা আলে ইমরান: ৩৬) যারা কন্যাসন্তানদেরকে আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করেছিল এবং নিজেদেরকে তাদের থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছিল, তাদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘এটাতো তাহলে এক অসঙ্গত বণ্টন!’ (সুরা নাজম: ২২)” ইমাম মুকবিলের বক্তব্য সমাপ্ত। বলা বাহুল্য, শেষোক্ত আয়াতটি দিয়ে ইমাম মুকবিল বুঝিয়েছেন, সুতরাং কুরআন অনুযায়ী নারী-পুরুষ সমান নয়। ইমাম মুকবিলের এই বক্তব্যের সূত্র: ইমাম মুকবিল আল-ওয়াদিয়ি কৃত তুহফাতুল মুজিব আলা আসইলাতিল হাদিরি ওয়াল গারিব; পৃষ্ঠা: ২২২; দারুল আসার, সানা (ইয়েমেন) কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৩ হি./২০০২ খ্রি. (২য় প্রকাশ)। অনুবাদকের টীকা সমাপ্ত।] [১৯]. আমরা আকিদা পোষণ করি, মুসলিমরা যে পর্যন্ত আল্লাহর কিতাব ও রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর দিকে ফিরে না আসছে, সে পর্যন্ত মুসলিমরা মর্যাদা ও বিজয় লাভ করতে পারবে না। · [২০]. আমরা হালের দলবাজ সংগঠনগুলোকে ঘৃণা করি—নাস্তিক কমিউনিস্ট পার্টি, নাস্তিক বাথিস্ট পার্টি, নাস্তিক নাসেরাবাদি দল, নাস্তিক সমাজতান্ত্রিক দল ও ধর্মত্যাগী রাফেজি গোষ্ঠী। আমরা মনে করি, মানুষ প্রধানত দুটো দলে বিভক্ত। একটি দয়াময় আল্লাহর দল। এদের মাঝেই কার্যকর হয় ইসলাম ও ইমানের স্তম্ভসমূহ, এরা আল্লাহর শরিয়তের কোনো অংশ প্রত্যাখ্যান করে না। আরেকটি শয়তানের দল। এরা আল্লাহর শরিয়তের বিরুদ্ধে লড়াইকারী সম্প্রদায়। [অনুবাদকের টীকা: প্রথমত, কমিউনিস্টদের মতাদর্শ কমিউনিজম তথা সাম্যবাদ। এ মতবাদের গোড়ায় রয়েছে স্রষ্টা ও ধর্মের প্রতি অস্বীকৃতি। দ্বিতীয়ত, বাথিস্ট পার্টির বাথিজম একটি ‘আরব জাতীয়তাবাদী’ আদর্শ, যা একটি ঐক্যবদ্ধ আরব রাষ্ট্রের ধারণা পোষণ করে। এই আদর্শ জাকি আরসুজি, মিশেল আফলাক ও সালাহুদ্দিন বিতারের তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটা একটা কুফরি মতাদর্শ। কারণ এদের নীতি হলো— পুরো আরব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা, চাই সে সুন্নি মুসলিম হোক বা রাফেজি শিয়া হোক, বা ইহুদি-খ্রিষ্টান হোক, বা অন্য কোনো কাফির হোক—তাতে কোনো যায় আসে না। লক্ষ্য একটাই— ঐক্যবদ্ধ হওয়া। তৃতীয়ত, নাসেরাবাদ একটি সুপরিচিত রাজনৈতিক মতাদর্শ। এটা মিসরের জামাল আব্দুন নাসিরের চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক আরব জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ। এটাও একটি কুফরি আদর্শ। কারণ এর মূলেই রয়েছে সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের মতো কুফরি ও আল্লাহদ্রোহী মতাদর্শ। চতুর্থত, রাফেজি সম্প্রদায় শিয়াদের একটি উপদল। নিজেদের ইমামরা গায়েব জানে এমন আকিদা পোষণ করা, আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার শানে ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া প্রভৃতির দরুন পূর্ববর্তী মুহাদ্দিস ইমামগণ এদেরকে কাফির আখ্যা দিয়েছেন। টীকা সমাপ্ত।] [২১]. যারা দ্বীনকে মৌল ও গৌন বলে দু ভাগ করে, আমরা তাদের বিরোধিতা করি। আমরা জানি, এটা ধ্বংসাত্মক দাওয়াত। [২২]. যারা সুন্নাহর ইলম আদানপ্রদান করা থেকে নিরুৎসাহিত করে, আর বলে, ‘এ ইলম দেওয়া-নেওয়ার সময় এখন নয়,’ আমরা তাদের বিরোধিতা করি। তদ্রুপ যারা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করা থেকে নিরুৎসাহিত করে, আমরা তাদেরও বিরোধিতা করি। [২৩]. আমরা মনে করি, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ক্রমান্বয়ে অগ্রবর্তী রাখতে হবে। সুতরাং আকিদা সংশোধনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া, তারপরে কমিউনিস্ট ও বাথিস্ট পার্টির বিনাশকার্যে গুরুত্বারোপ করা মুসলিমদের জন্য ওয়াজিব। আর কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেই কেবল তা সম্পন্ন হবে। · [২৪]. আমরা মনে করি, যে দল রাফেজি, কমিউনিস্ট, সুফি, সুন্নি সবাইকে দলের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়, তা শত্রুদের মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে না। কারণ এ কাজ সত্যিকারের ভ্রাতৃত্ব আর আকিদার সম্মিলন ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। [২৫]. যারা দাম্ভিকতা করে আর মনে করে, আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী দাঈরা ওয়াহাবি এজেন্ট, আমরা তাদের বিরোধিতা করি। আমরা মনে করি, তাদের উদ্দেশ্য অসৎ। তারা জনসাধারণ ও উলামাদের মাঝে প্রাচীর দিতে চায়। [২৬]. আমাদের আকিদা ও দাওয়াত আমাদের কাছে আমাদের জান, মাল ও সন্তানসন্ততির চেয়েও অধিক প্রিয়। আমরা এতে মোটেও প্রস্তুত নই যে, সোনারূপার বিনিময়ে আমরা এ আকিদা ও দাওয়াতকে বিকিয়ে দেব। আমরা এ কথা এজন্য বলছি, যাতে কোনো অতিপ্রত্যাশী এ দাওয়াতের ব্যাপারে এরূপ আশা ও ধারণা করে না বসে যে, দিনার-দিরহামের বিনিময়ে সে আমাদেরকে কাছে টানতে পারবে। যদিও আমাদের ব্যাপারে এ কথা রাজনীতিবিদদের জানা আছে। এজন্যই তারা আমাদেরকে পদ কিংবা ধনের লোভ দেখানোর ক্ষেত্রে নিরাশ হয়ে গেছে। · [২৭]. আমরা রাষ্ট্রের সরকারকে ভালোবাসি, যতটুকু কল্যাণ তার মাঝে রয়েছে ঠিক ততটুকু। আর তার মাঝে থাকা অকল্যাণের দরুন আমরা তাকে ঘৃণাও করি। আমরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৈধ মনে করি না। তবে আমরা যদি সরকারের মাঝে সুস্পষ্ট (বড়ো) কুফর দেখতে পাই, যে ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে দলিল রয়েছে, তাহলে বিদ্রোহ করা বৈধ মনে করি। তবে শর্ত হলো, আমাদেরকে বিদ্রোহ করার মতো ক্ষমতাবান হতে হবে এবং মুসলিমদেরই দু পক্ষের মাঝে লড়াই হওয়া চলবে না। কেননা শাসকরা বিদ্রোহীদেরকে অশান্তি-সৃষ্টিকারী বিনাশী লোক হিসেবে চিত্রায়িত করে থাকে। এখানে আরও কিছু শর্তের ব্যাপার রয়েছে, সেগুলো জানতে আমাদের অন্যান্য বই দেখুন। [২৮]. যে-ই আমাদেরকে নসিহত ও দিকনির্দেশনা দেয়, আমরা তা গ্রহণ করি। আমরা মনে করি, আমরা তালিবুল ইলম (ইলম অন্বেষণকারী)। আমরা যেমন সঠিক করি, তেমনি ভুলেও পতিত হই। আমরা যেমন নানাবিষয়ে জ্ঞান রাখি, তেমনি বিভিন্ন বিষয়ে অজ্ঞও থাকি। [২৯]. আমরা সামসময়িক সুন্নাহপন্থি উলামাদের ভালোবাসি, তাদের থেকে উপকৃত হতে অনুপ্রাণিত করি এবং তাঁদের অনেকের অচলাবস্থা দেখে ব্যথিত হই। [৩০]. আমরা আল্লাহর কিতাব কিংবা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুসাব্যস্ত সুন্নাহর দলিল ব্যতিরেকে কোনো ফতোয়া গ্রহণ করি না। · [৩১]. আমরা দায়িত্বশীল ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক লেনিন ও অন্যান্য নাস্তিক নেতাদের সম্মানার্থে কবর জেয়ারতে যাওয়ার বিরোধিতা করি। [৩২]. ইসলামের শত্রুদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হলে আমরা মুসলিম শাসকদের এ কাজের বিরোধিতা করি; চাই সেসব শত্রু আমেরিকান হোক, কিংবা কমিউনিস্ট। [৩৩]. যেসব জাহেলি দাওয়াত বর্তমান রয়েছে, যেমন জাতীয়তাবাদ, আরব জাতীয়তাবাদ প্রভৃতির বিরোধিতা করি, এগুলো জাহেলি যুগের দাওয়াত হিসেবে বিবেচনা করি এবং মুসলিমদের পশ্চাদ্পসারণের কারণ বলে মনে করি। [৩৪]. আমরা মুজাদ্দিদের (দ্বীনের সংস্কারক ব্যক্তিত্ব) প্রতীক্ষা করি, যার মাধ্যমে আল্লাহ দ্বীনের সংস্কার করেন। কারণ আবু দাউদ তদীয় সুনাহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ এই উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর শুরুতে এমন ব্যক্তি পাঠাবেন, যে এই উম্মতের জন্য তাদের দ্বীনের সংস্কারকাজ করবে।” [আবু দাউদ, হা: ৪২৯১; সনদ: সহিহ] আমরা আশা করি, ইসলামি জাগরণ মুজাদ্দিদ আসার পথ সুগম করবে। · [৩৫]. যারা মাহদি ও দাজ্জাল বিষয়ক এবং মরিয়ম তনয় ইসা আলাইহিস সালামের অবতরণ বিষয়ক হাদিসগুলো অস্বীকার করে, আমরা তাদেরকে পথভ্রষ্ট বলে বিশ্বাস করি। আমরা মাহদি বলতে রাফেজি শিয়াদের মাহদি বোঝাচ্ছি না। বরং মাহদি হলেন তিনি, যিনি নবি-পরিবার থেকে আগত ইমাম হবেন। তিনি আহলুস সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত হবেন। পৃথিবীকে তিনি ন্যায়-নিষ্ঠায় ভরপুর করে দেবেন, যেমন তা জুলুম ও অত্যাচারে পূর্ণ হয়ে আছে। আমরা বলেছি, তিনি আহলুস সুন্নাহর একজন হবেন। কারণ সম্মাননীয় সাহাবিদের গালি দেওয়া ন্যায়পরায়ণতার অন্তর্গত নয় (সুতরাং তিনি শিয়া হবেন না, বরং আহলুস সুন্নাহ হবেন)। [৩৬]. এই ছিল আমাদের আকিদা ও দাওয়াত বিষয়ে কয়েকটি কথা। দলিল-সহ এসবের আলোচনা কিতাবকে অনেক দীর্ঘয়ত করবে। অবশ্য এসবের অধিকাংশ দলিল আমি ‘আল-মাখরাজ মিনাল ফিতান’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। যে ব্যক্তির উল্লিখিত বিষয় নিয়ে যে কোনো ধরনের আপত্তি আছে, তিনি সঠিক হলে আমরা তাঁর নসিহত গ্রহণ করতে, ভুলকারী হলে তার সাথে ইলমি বিতর্ক করতে, আর হঠকারী হলে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত আছি। আর আল্লাহই সর্বাধিক অবগত। এই ছিল আমাদের কথা। তবে একটি বিষয় জেনে রাখা জরুরি, আলোচিত বিষয়গুলো আমাদের পুরো দাওয়াত ও আকিদাকে ধারণকারী সর্বব্যাপী আলোচনা নয়। কেননা আমাদের দাওয়াত মূলত কিতাব ও সুন্নাহর মাধ্যমেই কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহ্বানের দাওয়াত। আকিদার ব্যাপারটিও অনুরূপ। আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, আর তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক। আল্লাহর সাহায্য ব্যতিরেকে অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই এবং নেই সে পরিবর্তনের কোনো ক্ষমতা। · সমাপ্ত, আলহামদুলিল্লাহ। · অনুবাদক: মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা www.facebook.com/SunniSalafiAthari
Comments